প্রায় সাত মাসের ব্যবধানে জাতীয় কাউন্সিল সম্পন্ন করেছে দেশের বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুটি দলের কাউন্সিলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ ঘটেছে। দুটি কাউন্সিলেই যোগ দিয়েছেন বিদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বেশ কয়েকজন নেতা। এমনকি খাবার আয়োজনও দুটি দল প্রায় সমানভাবে করেছে। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সঙ্গে সঙ্গে কমিটি ঘোষণা করে কাউন্সিলের ফসল ঘরে তুলতে পেরেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু বেশ কয়েক মাস পরে এবং কয়েক দফায় কমিটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিএনপি পিছিয়ে পড়েছে। কারণ ওই কমিটি ঘোষণা সামনে রেখেই বিএনপিতে হতাশা, ক্ষোভ তথা দলাদলির সুযোগ তৈরি হয়েছে; যে দলাদলিতে বিএনপি এখনো ব্যস্ত। বলা হচ্ছে, শুধু সিদ্ধান্তহীনতার কারণেই কাউন্সিলের সুফল ভোগ করতে পারেনি দলটি।
কাউন্সিলের পর আওয়ামী লীগে চাঙ্গাভাব দেখে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মাঝে এখন এমন উপলব্ধির কথা জানা যায়। নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় তাঁরা বলছেন, এমন চাঙ্গাভাব বিএনপিতেও হওয়ার কথা ছিল। অথচ সর্বশেষ কাউন্সিলের পরে এ সুযোগটিই হাতছাড়া হয়ে গেছে।
শুধু তাই নয়, ২০ দলীয় জোটের বাইরে দেশের বড় কোনো রাজনৈতিক দলকেও কাউন্সিলে আনতে পারেনি বিএনপি। যদিও ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে অনেকে আসেনি বলে বিএনপি দাবি করে থাকে। কিন্তু ১৪ দলের বাইরে বেশ কয়েকটি দলের নেতাকে আনতে পেরেছে আওয়ামী লীগ।
পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাউন্সিলে সবচেয়ে বড় পার্থক্য বা তফাত এ দুটি ক্ষেত্রেই। তবে গত ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত বিএনপির কাউন্সিলে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দেওয়া বক্তব্য ওই সময় অপেক্ষাকৃত বেশি প্রশংসিত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কারণ খালেদা জিয়া তাঁর বক্তৃতায়—প্রথমত. সরকারি দল বা জোটকে গালাগালি করেননি; দ্বিতীয়ত. তিনি প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বদলে নতুন ধারার রাজনীতি চালু করার অঙ্গীকার করেছেন; তৃতীয়ত. বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের কথা তিনি স্বীকার করেছেন।
পক্ষান্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে এবার সরাসরি আক্রমণ না করলেও তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার জন্য নেতাকর্মীদের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। এ প্রসঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, তারা যেন ক্ষমতায় না আসতে পারে। বিএনপি এ বক্তব্যকে গণতন্ত্রের জন্য ‘বিপজ্জনক’ বলে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। অবশ্য ‘আগামী নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হোক তা আমি চাই না’—প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, ওই বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী ‘অর্থবহ’ করলে দেশে ভবিষ্যতে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাসচিব, প্রেসিডিয়ামসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশির ভাগ কমিটি ঘোষণা হওয়ার ঘটনা বিএনপির এবং পর্যবেক্ষক মহলেরও প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাদের মতে, এতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের সক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে। পাশাপাশি নেতাকর্মীরা চাঙ্গা ও দল গতিশীল হয়েছে। দলের ভেতরে চক্র-চক্রান্তের সুযোগও কমে গেছে। অথচ বিএনপি এ কাজটি সম্পন্ন করতে সময় নিয়েছে কয়েক মাস, যে কারণে দল স্থবির হয়ে পড়েছে। আবার কাউন্সিলের শেষ দিনেই নেতা নির্বাচিত হওয়ায় নেতাকর্মীদের ফুলের শুভেচ্ছায় সিক্ত হয়েছেন শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের। কিন্তু খালেদা জিয়া ও মির্জা ফখরুলের ভাগ্যে তা জোটেনি। কারণ কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে দলে এমন হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে, যাতে ফুল দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা বা পরিবেশই থাকেনি। উপরন্তু প্রথম দুই দফায় একজন যুগ্ম মহাসচিবকে দিয়ে কমিটি ঘোষণা করায় মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুলকে উপেক্ষা করা হয়েছে। কিছুদিনের জন্য এ নিয়ে দলে উত্তাপও ছড়িয়েছে।
বড় দুটি রাজনৈতিক দল ও জোটের বাইরে একমাত্র বিকল্প ধারার সভাপতি ও সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাউন্সিলে অংশ নিয়েছেন। জানতে চাইলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাউন্সিলে খুব বেশি পার্থক্য আমার চোখে পড়েনি। তবে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ‘ঐশ্বর্যে’র বহিঃপ্রকাশ অনেক বেশি ছিল, যা আগে কখনো দেখিনি। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী বক্তব্যে সাফল্যের কথা সবিস্তারে তুলে ধরা হলেও রাজনৈতিক সমস্যার কথা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।”
অবশ্য মহাসচিব পদসহ গুরুত্বপূর্ণ কমিটি কাউন্সিলের সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করা প্রশংসনীয় কাজ, যেটি বিএনপি করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, ‘প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চাই না’—প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য অবশ্যই সাহসী। কারণ এর মধ্য দিয়ে তিনি স্বীকার করে নিলেন, আগের নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তবু তাঁর ওই কথা আশার আলো হিসেবে চিন্তা করব কি না তা ভবিষ্যতে সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করলে বোঝা যাবে।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের মতে, ক্ষমতায় থাকার নানা সুবিধা নিয়ে জাতীয় কাউন্সিল করে আওয়ামী লীগ সারা ঢাকা শহর কাঁপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি সে সুবিধা পায়নি। তাদের মাত্র এক দিন আগে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও এটি ঠিক যে, কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে নেতা নির্বাচিত করে তাৎক্ষণিকভাবে কমিটি ঘোষণা হলে বিএনপি গতিশীল হতো। কিন্তু অমনক দিন ধরে সেটি না করায় বিএনপির নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়েছে, হতাশ হয়েছে। এর ফলে দলটিতে বিভেদ বা বিভাজন বেড়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি স্পষ্ট যে শক্তিশালী নেতৃত্বের পতাকাতলে আওয়াম লীগ এ মুহূর্তে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত বিএনপিতে সেই ঐক্য বা উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়নি। ইতিবাচক বক্তব্যের দিক দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের বক্তব্য বেশি প্রশংসিত হয়েছে বলেও মনে করেন এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাউন্সিলের মূল পার্থক্য হলো—শেখ হাসিনা সুপার রাজনৈতিক খেলোয়াড়। চমৎকার খেলে তিনি তাঁর বাবা শেখ মুজিবের আমলকেও ছাড়িয়ে গেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া নানা কারণে অবসাদে ভুগছেন। তা ছাড়া কিছু লোক তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। যে কারণে বিএনপিও ঘুমাচ্ছে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে দলের মধ্যকার সব বিরোধী নেতাকে শায়েস্তা করে গুরুত্বপূর্ণ কমিটির বাইরে রেখেছেন। পাশাপাশি আগামী কাউন্সিলে সজীব ওয়াজেদ জয় ইমার্জ করবেন—এই ব্যবস্থাও পাকাপোক্ত করেছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদেরও সঠিক পছন্দ। আর খালেদা জিয়ার ঘুম থেকে না জাগলে হবে না। তিনি কমিটি দিয়েছেন বেশ কয়েক মাস পরে। এতে দল স্থবির হয়ে গেছে। তাঁর মতে, কাউন্সিলে খালেদা জিয়ার বক্তব্য অবশ্যই ইতিবাচক। কারণ তিনি প্রতিশোধ নেবেন না বলেছেন। শেখ মুজিবের অবদানের কথাও তিনি স্বীকার করেছেন। কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতাই বিএনপিকে ডোবাবে, যোগ করেন তিনি।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে যোগ দিয়ে বিএনপি নেত্রীর বক্তৃতা দেওয়া উচিত ছিল। বলা উচিত ছিল, এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপিকে অনুমতি না দিলেও আপনি কাউন্সিল করছেন। কিন্তু সেখানে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বাধা দিয়েছেন। তাঁর মতে, এখনো সময় আছে, সকাল ১০টা থেকে তিনি কাজ শুরু করলে বিএনপি ক্ষমতায়ও যেতে পারে।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের মতে, অত্যন্ত স্মার্টলি আওয়ামী লীগ তাদের কমিটিগুলো আগে ঘোষণা করতে পেরেছে, যেটি বিএনপি পারেনি। এটি তাদের সফলতা। কিন্তু বাকি প্রায় সব বিষয়ে দুটি দলে মিল আছে। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা এবং বিএনপিতে খালেদা জিয়া—গণতান্ত্রিকভাবে দুটি দলেই একনায়কতন্ত্র চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ক্ষমতায় থেকে কাউন্সিল করলে সরকারি সুযোগ-সুবিধা সব সময়ই বেশি ব্যবহার করা যায়। ক্ষমতায় থেকে বিএনপিও একবার জাঁকজমকপূর্ণভাবে কাউন্সিল করেছে। এবার আওয়ামী লীগ একটু বেশি করেছে এই যা!
কাউন্সিলের মিল-অমিল : আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের কাউন্সিলেই রূপকল্প ঘোষণা করা হয়েছে। ভিশন ২০৪১ রূপকল্প ঘোষণা করে সেখানে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ জন্য নেতাকর্মীদের তালিকা তৈরি করে তা পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া তাঁর বক্তৃতায় আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নেতাকর্মীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিএনপির কাউন্সিলে ‘ভিশন ২০৩০’ রূপকল্প ঘোষণা করে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দেওয়া ইতিবাচক বক্তব্য জনমনে বেশ সাড়া ফেলেছিল। বলা হয়েছিল, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য এনে দুই কক্ষের সংসদ করা হবে। অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে নতুন ধারার রাজনীতি ও সরকার প্রতিষ্ঠারও অঙ্গীকার করেন খালেদা জিয়া। বক্তব্যে খালেদা জিয়া সংলাপের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ঘোষণা করেন।
পাঠকের মতামত: